‘একজন করে চিকিৎসকের নিঃশব্দ প্রস্থান আমাদের বিমূঢ় করে রেখে যায়। অন্যদের মৃত্যুতেও আমরা কষ্ট পাই। কিন্তু সহকর্মীদের মৃত্যু আমাদের হৃদয় থেকে সব সাহস, ধৈর্য শুষে নিতে চায়’—ফেসবুকে ২০২০ সালে পোস্টটি দিয়েছিলেন ওই সময় রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) প্রধান চিকিৎসক শাহজাদ হোসেন। করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগী ও সহকর্মীদের মৃত্যুতে এভাবে তিনি নিজের মর্মবেদনা ব্যক্ত করেন।
শাহজাদ হোসেন ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এই হাসপাতালের কোভিডকালের আইসিইউর দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে হাসপাতালের অ্যানেসথেশিওলজি বিভাগের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
চীনে ২০১৯ সালের শেষ দিকে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। পরে ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বৈশ্বিক স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। গত ৫ মে সেই জরুরি অবস্থার সমাপ্তি টেনেছে সংস্থাটি।
করোনাকালের সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা কথা বলতে গিয়ে শাহজাদ হোসেন গত ৩০ মে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুরুর সময়টা খুব ভয়ংকর ছিল। মানসিক চাপ লাগত। আইসিইউর প্রধান হিসেবে পুরো দলের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়েছে। চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা পারিবারিক, সামাজিক ও মানসিক চাপে ছিলেন।’
করোনা মহামারির এই সম্মুখযোদ্ধার কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে জার্মান সাময়িকী স্প্রিঙ্গারের অনলাইনে প্রকাশিত এক বৈশ্বিক গবেষণায়ও। প্রাণঘাতী এই মহামারির সময় চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর কেমন মানসিক ধকল গেছে, সে চিত্র উঠে এসেছে ‘রেজাল্টস অব দ্য কোভিড-১৯ মেন্টাল হেলথ ইন্টারন্যাশনাল ফর দ্য হেলথ প্রফেশনাল স্টাডি: ডিপ্রেশন, সুইসাইডাল টেন্ডেনসিস অ্যান্ড কন্সপিরেসিজম’ শীর্ষক এক গবেষণায়।
![যশোরে ২০২১ সালের জুনে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। হাসপাতালের শয্যায় জায়গা না থাকায় করোনা আক্রান্ত রোগীদের ঠাঁই হয় মেঝেসহ বারান্দায়। ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের নারী আইসোলেশন ওয়ার্ডে](https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2023-06%2F94c7eeeb-43eb-4b1b-897b-b6506b75d530%2Fcorona_2.webp?auto=format%2Ccompress&fmt=webp&format=webp&w=640&dpr=1.0)
যশোরে ২০২১ সালের জুনে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। হাসপাতালের শয্যায় জায়গা না থাকায় করোনা আক্রান্ত রোগীদের ঠাঁই হয় মেঝেসহ বারান্দায়। ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের নারী আইসোলেশন ওয়ার্ডেফাইল ছবি
বিশ্বের ৪০টি দেশের জনস্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উদ্যোগে এ গবেষণা পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ থেকে এক চিকিৎসকসহ তিনজন এ গবেষণায় যুক্ত ছিলেন।
মানসিক পীড়া-অবসাদ
চলতি বছরে ৩ মার্চ প্রকাশিত এ গবেষণায় করোনাকালে বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, করোনাকালে স্বাস্থ্য পেশার সঙ্গে যুক্ত ২৮ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ মানসিক পীড়া ও চরম অবসাদে ভুগছেন। এর মধ্যে মানসিক পীড়ায় ভুগছেন ১৫ দশমিক ১৯ শতাংশ আর চরম অবসাদে ভুগছেন ১৩ দশমিক ৩১ শতাংশ।
আলাদাভাবে চিকিৎসকদের ২৮ দশমিক ১৭ শতাংশ, নার্সদের প্রায় ৩১ শতাংশ, অন্য স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের প্রায় ২৭ শতাংশ, হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৩০ শতাংশ এবং হাসপাতালের অন্য কর্মীদের প্রায় ৩৩ দশমিক ৫১ শতাংশ মানসিক পীড়া ও চরম অবসাদে ভুগছেন।
এ গবেষণায় বাংলাদেশসহ ৪০টি দেশের ৫৫ হাজার ৫৮৯ জন অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশের ছিলেন ৩ হাজার ৩৩ জন, যা মোট অংশগ্রহণকারীর ৫ শতাংশের বেশি। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যায় রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও গ্রিসের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। মোট অংশগ্রহণকারীর মধ্যে স্বাস্থ্য পেশাজীবী ছিলেন ১২ হাজার ৭৯২ জন, যার ৬২ শতাংশ হলেন নারী।
‘রোগীর হাত ধরে পরিবারে কথা মনে পড়ত’
‘রোগীর স্বজনদের হাসপাতালে ঢুকতে দেওয়া হতো না। কিছুটা জ্ঞান আছে—এমন রোগীরা আমাদের হাত ধরতে চাইতেন। তাঁদের হাত ধরে থাকতাম। ভাবতাম, এই মানুষটির জায়গায় আমার পরিবারের কেউ হতে পারত!’—করোনাকালে হাসপাতালে আইসিইউতে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা গত ৩১ মে এভাবে প্রথম আলোকে বলছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ নার্স রিক্তা বেগম। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে পরবর্তী ১০ মাস তিনি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
রিক্তা বেগম জানান, ওই সময় আট মাস ভোলায় অবস্থান করা নিজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে পারেননি তিনি। কোভিডে আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের বাঁচানোর লড়াই, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার সময়ে একধরনের কষ্ট বোধ করতেন।
রিক্তা বেগমের মতো একই সময়ে একই হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডের নার্স ছিলেন মোছা. শারমিন আক্তার। তিনি এখন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ নার্স। গত ৩০ মে প্রথম আলোকে শারমিন বলেন, ওই সময় তাঁর শিশুসন্তানের বয়স ছিল এক বছর। তাঁর কাছ থেকে পরিবারের সদস্যদের কোভিড ছড়ায় কি না, সেটা নিয়ে উৎকণ্ঠায় ভুগতেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের প্রায় ৮১ শতাংশ বিধিনিষেধের মধ্যে কাজ করে গেছেন। অংশগ্রহণকারীদের বড় একটি অংশ পরিবারের লোকজনের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো এবং সম্পর্কগুলো আরও মজবুত করার তাগিদ অনুভব করেছেন। প্রায় ৪৮ শতাংশ জানিয়েছেন, কোভিডের কারণে তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে সাধারণ মানুষ ও স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত পেশাজীবীরা চরম মানসিক অবসাদ, অনিদ্রা ও পিটিএসডিতে (ঘটনাপরবর্তী উৎকণ্ঠা) ভুগেছেন। তবে ওই সময় তথ্যের ঝড় বইতে থাকে, সেসব তথ্যের অনেকগুলোর নির্ভরযোগ্যতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল।
এর আগে প্রায় ৫৫ হাজার অংশগ্রহণকারীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দুটি গবেষণা হয়। নেদারল্যান্ডসের শিক্ষাবিষয়ক প্রকাশনাপ্রতিষ্ঠান এলসেভিয়ারে প্রথম প্রতিবেদনটি ২০২১ সালের অক্টোবরে এবং দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি ২০২২ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হয়।
প্রথম প্রতিবেদনে সাধারণ মানুষের করোনাকালে উৎকণ্ঠার হার ২৫ ও বিষণ্নতার হার ২৮ বলা হয়। দ্বিতীয় প্রতিবেদনে বিভিন্ন মাত্রার বিধিনিষেধে কমবেশি এক-তৃতীয়াংশ মানুষের তীব্র মানসিক চাপ, উৎকণ্ঠা ও বিষণ্নতায় ভোগার আলাদা চিত্র তুলে ধরা হয়।
‘বড় বিপর্যয়ে প্রস্তুতির বার্তা’
স্প্রিঙ্গারে প্রকাশিত গবেষণায় বাংলাদেশ থেকে এক চিকিৎসকসহ তিনজন যুক্ত ছিলেন। তাঁরা হলেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তাসদিক এম হাসান ও শাহাদাত হোসেন।
হেলাল উদ্দিনের মতে, গবেষণাটি ভবিষ্যতে মহামারি বা বড় বিপর্যয়ে মানসিক সুস্থতার বিষয়ে আগাম সতর্কবার্তা দিচ্ছে। ভবিষ্যতে মহামারি মোকাবিলায় মানসিক সুস্থতার জন্য সেবা, যত্ন, সচেতনতা ও প্রস্তুতি কী রকম হওয়া উচিত, সে বিষয়ে গবেষণাটি দিকনির্দেশক হবে।
এ চিকিৎসক বলেন, কোভিডে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি ছিল। তবে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য পেশায় যুক্ত ব্যক্তিদের ভীতি ছিল অন্য রকম। পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যক্তিজীবন ভুলে ঝুঁকি নিয়ে সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে তাঁরা মানুষের সেবা করেছেন। এ অবস্থায় অনেকে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, অনেকে মানসিক রোগেও আক্রান্ত হয়েছেন।
হেলাল উদ্দিন বলেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবার পরিধির মধ্যে এসব মানুষের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার বিষয়টি যুক্ত করা উচিত, যাতে তাঁরা তীব্র মানসিক চাপের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন; একই সঙ্গে তাঁরা যেন ছুটি, প্রণোদনা ও কাজের স্বীকৃতি পান।
Add comment