Nazihar News Network
News from Nazihar It Solution

হেফাজতে আলালের মৃত্যু নিয়ে এত লুকোচুরি কেন

এই হাসপাতালে মামলা আছে বা হতে পারে, এমন ব্যক্তিদের নাম লেখা থাকে পুলিশ কেস লেখা একটি খাতায়। ৬ থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত আলাল নামের দুজন ভর্তি হন, তাঁদের একজনের বয়স ২৮, অন্যজনের ৭০। একজন ভর্তি হয়েছিলেন কেটে যাওয়ার কারণে, অন্যজন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়ে। আলালের পায়ে আঘাত লাগল কী করে, সেই আঘাত কতটা গুরুতর, কোনো অস্ত্রোপচার হয়েছিল কি না, হলে কোথায় কত তারিখে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।

২০১৬ সালে উচ্চ আদালত ৫৪ ও ১৬৭ ধারার অপব্যবহার রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারিক আদালতের প্রতি নির্দেশনা জারি করেন।

ডিবি হেফাজতে ১৯৯৮ সালে ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামীম রেজা রুবেলের মৃত্যু, চট্টগ্রামের রাউজানে পুলিশ হেফাজতে সীমা চৌধুরীকে ধর্ষণ ও হত্যা এবং মালিবাগে থানা হেফাজতে অরুণ চক্রবর্তী নামের এক যুবকের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে একাধিক মানবাধিকার সংগঠন সে সময় আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল।

রাজধানীর তুরাগ থানা এলাকার বাসিন্দা আলাল উদ্দিন ১৬ জুন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে মারা যান। র‌্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর মাস তিনেকের মাথায় এবার ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হেফাজতে মৃত্যু হলো আলাল উদ্দিনের। আলালের মৃত্যুর পর পুলিশ বলছে, তিনি একটি হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি ছিলেন। পায়ে আঘাত থাকায় পুলিশ তাঁকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখান থেকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঠানো হলে চিকিৎসক আলালকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে এর বাইরে আরও যেসব প্রশ্ন উঠছে, সেগুলোর কোনো জবাব দিচ্ছে না পুলিশ।

বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ সব ক্ষেত্রে রাখঢাক করে এমন নয়। জঙ্গি দমনে বড় বড় অভিযান শেষে তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মাদক ও খোয়া যাওয়া মুঠোফোন উদ্ধার থেকে শুরু করে ‘ক্লুলেস’ হত্যা মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটনের খবর জানাতেও তারা বেশ তৎপর। পুলিশ, সিআইডি, পিবিআই, র‌্যাবসহ কেউ সেখানে পিছিয়ে নেই। কিন্তু আলাল উদ্দিনের ব্যাপারে পুলিশ মুখ খুলছে না।

পত্রিকান্তরে জানা যাচ্ছে, পরিবারের অভিযোগ, তাঁকে (আলাল) ৬ জুন ফোন করে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর পাক্কা ১০ দিন তাঁর কোনো খোঁজ ছিল না।

এরপর পরিবারের লোকজনকে পুলিশ ফোন করে আলালের মৃত্যুর খবর দেয়। এ নিয়ে সংবাদপত্রগুলো পুলিশের উত্তরা বিভাগ, ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। কেউই সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেয়নি।

ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ১০ জুন আলালকে একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অসুস্থ হয়ে পড়লে আদালতের নির্দেশে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রশ্নের জবাবে এই একই কর্মকর্তা বলেন, ডিবি যখন আলালকে ধরে, তখনই তাঁর ‘পা ভাঙা’ ছিল। পঙ্গু হাসপাতালে পাঁচ-সাত দিন চিকিৎসাধীন থাকার এক পর্যায়ে তাঁর রক্তচাপ হঠাৎ বেড়ে যায়। তখন পঙ্গু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঠায়।

ডিবির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার আকরামুল হক সমকালকে বলেন, গ্রেপ্তারের সময় কিছুটা অসুস্থ ছিলেন আলাল উদ্দিন। তাঁর পায়ে আঘাত ছিল। সেদিনই আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাঁকে হাসপাতালে ভর্তির নির্দেশ দেন। এরপর তাঁকে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়।

আলাল উদ্দিন

আলাল উদ্দিনছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন উঠছে, ৬ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত আলাল উদ্দিন কোথায় ছিলেন? পুলিশ কত তারিখে আলাল উদ্দিনকে আদালতে হাজির করে? আদালতের নির্দেশে কবে তাঁকে পুলিশ জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করে?

পরিবারের ভাষ্য যদি ঠিক বলে ধরে নিই, তাহলে তুলে নেওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়নি। আলালের পরিবার বলছে, তিনি পায়ে হেঁটে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের একজন কর্মী প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁর পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল। পঙ্গু হাসপাতালের একটি স্লিপ নিয়ে পুলিশ আলালকে ১৬ জুন সন্ধ্যা সাতটার দিকে নিয়ে আসে। আলালের মৃত্যুসনদ অনুযায়ী, তিনি সন্ধ্যা সাতটায় হাসপাতালে আসেন। ৭টা ৫ মিনিটে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এর পাঁচ মিনিট পর চিকিৎসক তাঁর মৃত্যুসনদ লেখেন।

তাহলে আলালকে কি মৃত অবস্থায় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে আনা হয়েছিল? পঙ্গু হাসপাতাল তাঁকে পাশের হাসপাতালে পাঠাতে এত দেরি করল কেন? ১৯ জুন পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে আলাল উদ্দিনের ভর্তি সম্পর্কিত তথ্যের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি।

ঢাকায় পুলিশি হেফাজতে ২০১৪ সালে ‘জনি’ হত্যার ৬ বছর পর ঢাকার নিম্ন আদালতে রায় পেয়েছেন তাঁর ভাই রকি। উচ্চ আদালতে সে মামলা এখনো চলছে। সিলেটে রায়হান আহমেদ নামের এক যুবকের হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ওই ঘটনায় বিচার এখন চলছে। তবে আলালের মতো প্রান্তিক মানুষ, এই শহরে যাঁর পরিচয় একজন ‘দারোয়ান’, তাঁর পরিবার বিচার পাবে কি না, কে জানে।

এই হাসপাতালে মামলা আছে বা হতে পারে, এমন ব্যক্তিদের নাম লেখা থাকে পুলিশ কেস লেখা একটি খাতায়। ৬ থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত আলাল নামের দুজন ভর্তি হন, তাঁদের একজনের বয়স ২৮, অন্যজনের ৭০। একজন ভর্তি হয়েছিলেন কেটে যাওয়ার কারণে, অন্যজন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়ে। আলালের পায়ে আঘাত লাগল কী করে, সেই আঘাত কতটা গুরুতর, কোনো অস্ত্রোপচার হয়েছিল কি না, হলে কোথায় কত তারিখে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।

২০১৬ সালে উচ্চ আদালত ৫৪ ও ১৬৭ ধারার অপব্যবহার রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারিক আদালতের প্রতি নির্দেশনা জারি করেন।

ডিবি হেফাজতে ১৯৯৮ সালে ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামীম রেজা রুবেলের মৃত্যু, চট্টগ্রামের রাউজানে পুলিশ হেফাজতে সীমা চৌধুরীকে ধর্ষণ ও হত্যা এবং মালিবাগে থানা হেফাজতে অরুণ চক্রবর্তী নামের এক যুবকের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে একাধিক মানবাধিকার সংগঠন সে সময় আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল।

সেই ধারাবাহিকতায় আদালত আসামিদের সঙ্গে আচরণ কী হবে, তা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ১০ দফা নির্দেশনা দেন। তাঁরা বলেন, গ্রেপ্তারের ১২ ঘণ্টার মধ্যে আসামির স্বজনকে জানাতে হবে। গ্রেপ্তারের সময়, স্থান, কোথায় আটক রাখা হয়েছে, সে খবরও দিতে হবে। আলাল কিংবা জেসমিনের ঘটনায় এটা পরিষ্কার যে আসামির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আচরণ কেমন হবে, তা নিয়ে আদালতের নির্দেশনা বাহিনীগুলো মানছে না।

হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন ঠেকাতে ২০১৩ সালে নতুন আইনও হয়েছে, তাতেও খুব একটা লাভ হচ্ছে না। গত ১০ বছরে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অজস্র অভিযোগ এলেও গোটা বিশেক মামলা হয়েছে। যাঁরা মামলা করেছেন, তাঁদেরও ঝক্কির শেষ নেই।

ঢাকায় পুলিশি হেফাজতে ২০১৪ সালে ‘জনি’ হত্যার ৬ বছর পর ঢাকার নিম্ন আদালতে রায় পেয়েছেন তাঁর ভাই রকি। উচ্চ আদালতে সে মামলা এখনো চলছে। সিলেটে রায়হান আহমেদ নামের এক যুবকের হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ওই ঘটনায় বিচার এখন চলছে। তবে আলালের মতো প্রান্তিক মানুষ, এই শহরে যাঁর পরিচয় একজন ‘দারোয়ান’, তাঁর পরিবার বিচার পাবে কি না, কে জানে।

শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

Add comment

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.