Nazihar News Network
News from Nazihar It Solution

এআই প্রেজেন্টার অপরাজিতা খবর পড়ল, আমার–আপনার কী হবে?

দেখতে বাঙালি গড়ন। কালো হরিণচোখ। ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক—বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে ‘অপরাজিতা’ নামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির এক সংবাদ উপস্থাপক (এআই প্রেজেন্টার) বাংলায় খবর পড়ল গতকাল ১৯ জুলাই সন্ধ্যা সাতটায়। তাক লেগে গেল সবার, আলোচনায় মুখর হয়ে উঠলাম আমরা। সফটওয়ারের মাধ্যমে তৈরি করা অপরাজিতাকে নিয়ে তাই এখন অনেকেই মাতোয়ারা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেটিজেনরা এ নিয়ে পক্ষে–বিপক্ষে দিচ্ছেন নানা মত। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়টি নিয়ে কথা চলছে বেশ আগে থেকেই। আর বিশ্ব চলচ্চিত্রাঙ্গনও এখন এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের ধাক্কায় টালমাটাল। ভাবছেন, এসব তো শুধু সিনেমা ও টেলিভিশনে ঘটছে, আমরা তো ঠিকই আছি। না জনাব, আপনি একদমই ভুল ভাবছেন, যেকোনো মুহূর্তে সিনেমা থেকে বাস্তবে আমাদের ওপরও নেমে আসতে পারে এআইয়ের ধাক্বা। আর তাতে যে আমি–আপনি টালমাটাল হব না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?

দেখতে বাঙালি গড়ন। কালো হরিণচোখ। ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক—বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে ‘অপরাজিতা’ নামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির এক সংবাদ উপস্থাপক (এআই প্রেজেন্টার) বাংলায় খবর পড়ল গতকাল ১৯ জুলাই সন্ধ্যা সাতটায়। তাক লেগে গেল সবার, আলোচনায় মুখর হয়ে উঠলাম আমরা। সফটওয়ারের মাধ্যমে তৈরি করা অপরাজিতাকে নিয়ে তাই এখন অনেকেই মাতোয়ারা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেটিজেনরা এ নিয়ে পক্ষে–বিপক্ষে দিচ্ছেন নানা মত। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়টি নিয়ে কথা চলছে বেশ আগে থেকেই। আর বিশ্ব চলচ্চিত্রাঙ্গনও এখন এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের ধাক্কায় টালমাটাল। ভাবছেন, এসব তো শুধু সিনেমা ও টেলিভিশনে ঘটছে, আমরা তো ঠিকই আছি। না জনাব, আপনি একদমই ভুল ভাবছেন, যেকোনো মুহূর্তে সিনেমা থেকে বাস্তবে আমাদের ওপরও নেমে আসতে পারে এআইয়ের ধাক্বা। আর তাতে যে আমি–আপনি টালমাটাল হব না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?

জেমস ডিন

জেমস ডিনছবি: সংগৃহীত

বাস্তবের কথা বিস্তারিত করার আগে সিনেমার কথাটি বরং খানিকটা বলে নিই। তাহলে সহজেই বোঝা যাবে যে এখন কোথায় আছি আমরা। ‘সিনেমা সিনেমা সিনেমা/ আজ সিনেমার বড় দিন…।’—গেয়েছিলেন অঞ্জন দত্ত, সেই ১৯৯৮ সালে। সে গানে আছে, প্রযোজক বারবার পরিচালককে বলছেন, সিনেমায় একটা ‘দুষ্টু গান’ ঢোকান, যাতে ‘ভালো ছবিটাও’ চলে।

‘ভালো ছবি’ চালাতে এমন ‘দুষ্টু’ কাজের নজির আমরা দেখেছি যুগে যুগে। আর সেই সঙ্গে বারবারই উঠেছে সেই পুরোনো প্রশ্ন, সিনেমা আসলে কী?

সিনেমা কারও কাছে জীবনের প্রতিফলন, কারও কাছে শিল্প আর কারও কাছে শুধুই বিনোদন। তবে একটি বিনোদন পণ্য হিসেবে যাত্রা শুরু করা সিনেমার প্রাযুক্তিক ও ব্যবসায়িক দিক অস্বীকার করার কোনো উপায়ই এখন আর নেই। আর এই দুই দিক বিবেচনায় বর্তমানে সিনেমার ভবিষ্যৎ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট’ বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—সোজা কথায় এআই।

‘স্টার ওয়ার্স: দ্য রাইজ অব স্কাইওয়াকার’ সিনেমায় ক্যারি ক্যারি ফিশারের এই ছবি তাঁর মৃত্যুর পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে

‘স্টার ওয়ার্স: দ্য রাইজ অব স্কাইওয়াকার’ সিনেমায় ক্যারি ক্যারি ফিশারের এই ছবি তাঁর মৃত্যুর পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা হয়েছেছবি: সংগৃহীত

আপনার প্রিয় নায়ক বা নায়িকা, যিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়েছেন, তিনি যদি আবার পর্দায় ফেরেন সেই চিরসবুজ অবতারে, কেমন লাগবে? একজন ভক্ত কিংবা নেহাত চলচ্চিত্রপ্রেমী হিসেবে কেমন বোধ করবেন আপনি? ঠিক এমনটাই ঘটতে যাচ্ছে জেমস ডিন–ভক্তদের জন্য। ১৯৫৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে মারা যান মার্কিন এই অভিনেতা। মাত্র তিনটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন পুরো ক্যারিয়ারে।

তারপরও ‘রেবেল উইদাউট কজ’ সিনেমার এই নায়কের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। এখন তাঁকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে ‘ব্যাক টু ইডেন’ নামে একটি সিনেমায়। যেখানে ডিপফেকের (ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে যখন কারও মুখচ্ছবি অন্য কারও দেহে বসিয়ে দেওয়া হয়, তা হলো ডিপফেক) মতোই একটি এআই প্রযুক্তির ব্যবহারে তাঁর ডিজিটাল ক্লোন তৈরি করা হবে। জেমস ডিনের এই ডিজিটাল অবতার হাঁটবে, কথা বলবে, এমনকি অন্য অভিনেতাদের সঙ্গে পর্দায় আলাপও করবে। হলিউডের ‘কম্পিউটার জেনারেটেড ইমাজেরি’ (কম্পিউটারে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি করা ইমেজ) বা সিজিআই প্রযুক্তির সর্বোচ্চ উৎকর্ষ এই নতুন এআই প্রযুক্তি।

‘ফিউরিয়াস সেভেন’ সিনেমায় পল ওয়াকারের ছবিটিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা হয় এই অভিনেতার মৃত্যুর পর

‘ফিউরিয়াস সেভেন’ সিনেমায় পল ওয়াকারের ছবিটিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা হয় এই অভিনেতার মৃত্যুর পরছবি: সংগৃহীত

‘ইমার্সিভ মিডিয়া এজেন্সি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড এক্স আর’ বা ডব্লিউএক্সআর এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিএমজি ওয়ার্ল্ডওয়াইডের কাছে জেমস ডিনের মতো শত শত মানুষের ছবি রয়েছে। এঁদের মধ্যে আছেন এমেলিয়া ইয়ারহার্ট, বেটি পেজ, ম্যালকম এক্স ও রোজা পার্কের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব।

৬৮ বছর আগে জেমস ডিন যখন মারা যান, তখন তিনি চলচ্চিত্র ও স্থিরচিত্রে নিজের অবয়ব ও কণ্ঠস্বর রেখে গেছেন। এটাকেই ডব্লিউআরএক্স বলছে ‘সোর্স ম্যাটেরিয়াল’ বা উৎস–উপাদান। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ট্র্যাভিস ক্লয়েড বিবিসিকে বলেছেন জেমস ডিনের ইমেজ তৈরির প্রক্রিয়া সম্বন্ধে। তিনি বলেন, ডিনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি পেতে তাঁর অসংখ্য ছবি স্ক্যান করা হয় এবং এক দল ডিজিটাল বিশেষজ্ঞ সেই ছবিগুলো নিয়ে কাজ করেন। পরে অডিও, ভিডিও এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয় ঘটানোর পর এই ছবিগুলো হয়ে ওঠে ডিনের ডিজিটাল প্রতিরূপ, যা তাঁর মতো দেখতে, কণ্ঠস্বরও তাঁর মতো; এমনকি ডিনের ডিজিটাল প্রতিরূপটি প্রতিক্রিয়াও দিতে সক্ষম।

তবে জেমস ডিন যা রেখে যাননি তা হলো, ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট। আজকাল তারকারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক সক্রিয়। তাঁরা সেলফি তোলেন, ভিডিও পোস্ট করেন, বার্তা আর ই–মেইল পাঠান, ব্যবহার করেন সার্চ ইঞ্জিন। এ ছাড়া অনলাইনে কেনাকাটা করেন আর এভাবেই তাঁরা রেখে যান বিপুল পরিমাণ তথ্য, যা থেকে নির্ণয় করা সম্ভব হয় তাঁদের পছন্দ–অপছন্দ, চিন্তার ধরন ও অনুভূতির ছক। এই তথ্য ব্যবহার করে তৈরি করে ফেলা সম্ভব তাঁদের ডিজিটাল অবতার বা যমজ, যা এতই বুদ্ধিমান যে জীবন্ত মানুষের সঙ্গে অবলীলায় কথা চালিয়ে যেতে পারে।

আজকাল তারকারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক সক্রিয়। তাঁরা সেলফি তোলেন, ভিডিও পোস্ট করেন, বার্তা আর ই–মেইল পাঠান, ব্যবহার করেন সার্চ ইঞ্জিন। এ ছাড়া অনলাইনে কেনাকাটা করেন আর এভাবেই তাঁরা রেখে যান বিপুল পরিমাণ তথ্য, যা থেকে নির্ণয় করা সম্ভব হয় তাঁদের পছন্দ–অপছন্দ, চিন্তার ধরন ও অনুভূতির ছক। এই তথ্য ব্যবহার করে তৈরি করে ফেলা সম্ভব তাঁদের ডিজিটাল অবতার বা যমজ, যা এতই বুদ্ধিমান যে জীবন্ত মানুষের সঙ্গে অবলীলায় কথা চালিয়ে যেতে পারে।

এখন এমন অনেক কোম্পানি রয়েছে, যারা ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে তাঁদের মৃত স্বজনদের তথ্য নেয়।

এরপর সেই তথ্য ব্যবহার করে তৈরি করে ‘ডেডবট’, যা আপনার সঙ্গে ওই মৃত স্বজন হয়ে কথাও বলতে পারে। যত বেশি উৎস–উপাদান, ‘ডেডবট’, ততই নিখুঁত ও বুদ্ধিমান ডিজিটাল ক্লোন তৈরি করা যায়, অর্থাৎ বাস্তবের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হয়। তাঁর মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে উৎস–উপাদান পেলেই যেকোনো তারকার ডিজিটাল ক্লোন তৈরি করে ফেলা যাবে, যা চিরকাল অভিনয় করতে পারবে রুপালি পর্দায়।

এই বাস্তবতায় এখন প্রশ্ন উঠেছে, এই ডিজিটাল ক্লোনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব কে নেবে এবং এর প্রভাব পড়বে কাদের ওপর? নিজের প্রতিরূপের ওপর কি মৃতদের কোনো অধিকার থাকে না?
সাধারণত কোনো তারকার মৃত্যুর পর তাঁর ‘প্রচার অধিকার’ নিকটাত্মীয় বা উত্তরাধিকারীরা পেয়ে থাকেন।

এই প্রচার অধিকারের আওতায় থাকে মৃত তারকার ছবি বা প্রতিরূপের বাণিজ্যিক ব্যবহারে অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টি। তবে এই ছবি বা প্রতিরূপ কীভাবে ব্যবহার করা হবে সে বিষয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। একজন অভিনয়শিল্পী জীবদ্দশায় নিজের যে ভাবমূর্তি তৈরি করে গেছেন, তা একলহমায় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে তাঁকে মৃত্যু–পরবর্তী উপস্থাপনের মাধ্যমে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবমাননা ঠেকাতে তারকা বা তাঁদের উত্তরাধিকারীদের ‘ব্যবস্থা’ নিতেও দেখা গেছে। যেমন হলিউড তারকা রবিন উইলিয়ামস উইল করে মৃত্যুর পর তাঁর ছবি বা প্রতিরূপের ব্যবহার সীমিত করে গেছেন।

অবশ্য এই উইলের কার্যকারিতা মাত্র ২৫ বছর, এরপর আর তা খাটবে না। আবার মেরিলিন মনরোর সম্পত্তি দেখভালকারী সংগঠনের অনুমতি ছাড়া তাঁর ছবি বা প্রতিরূপ কোনো পর্নোগ্রাফিক চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা যাবে না—এমন কথাও বলা হয়েছে। তবে সবই আসলে নির্ভর করে পরিবার বা উত্তরাধিকারীর মর্জি–মনোভাবের ওপর। তাঁরা যদি সিদ্ধান্ত নেন, অর্থের বিনিময়ে মৃত তারকার প্রতিচ্ছবি বিক্রি করে দেবেন, তাঁদের ঠেকানোর আইনি কোনো উপায় নেই।

এ তো গেল তারকাদের কথা। তাঁরা তা–ও কিছু সুরক্ষার সুফল ভোগ করেন। কিন্তু আপনি বা আমি—আমরা যাঁরা আমজনতা, তাঁদের বেলায় কী ঘটবে? আপনার–আমার মতো সাধারণ মানুষের ছবিও তো যে কেউ কোনো এআই সফটওয়্যারে আপলোড করে দিতে পারে এবং তৈরি করে ফেলতে পারে এআই অবতার বা ডেডবট। কী ঘটবে তখন?

এ আলোচনা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে যখন ৪৩ বছরে প্রথমবারের মতো ধর্মঘটে গেছেন হলিউডের অভিনয়শিল্পীরা। এখন তাঁদের বড় শঙ্কা, তাঁদের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে এআইয়ের অ্যালগরিদম। ক্যারি ফিশার, হ্যারল্ড রামিস ও পল ওয়াকারের মতো তারকারা মৃত্যুর পরও তাঁদের আইকনিক চরিত্রে ফিরে আসছেন এআইয়ের সহযোগিতায়। ব্রাজিলীয় সংগীতশিল্পী এলিস রেজিনার পুনর্জন্ম ঘটানো হয়েছে একটি গাড়ির বিজ্ঞাপনের জন্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে অভিনেত্রী সুজান সারান্ডন শঙ্কা জানিয়ে বলেছেন, এআই হয়তো তাঁকে ‘এমন সব কথা বলতে এবং এমন সব কাজ করতে বাধ্য করবে, যেখানে আমার কোনো পছন্দ–অপছন্দ থাকবে না।’

অস্তিত্বের এই লড়াইয়ে যদি অভিনয়শিল্পীদের হার হয়, অগণিত মানুষ শুধু কাজই হারাবেন না, বলিতে চড়বে সৃজনশীলতা ও মানবিক অভিব্যক্তিও। আর এরপর আমাদের মতো আমজনতার কী হবে, চলুন এখন থেকে সেই ‘অ্যালগরিদম’–এর হিসাব শুরু করি!

Add comment

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.