Nazihar News Network
News from Nazihar It Solution

কোক স্টুডিও বাংলার গান নিয়ে দর্শকের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কারণ কী?

হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মধ্যে ইতালীয় কৃষক-শ্রমিকেরা নিজেদের উদ্দীপিত রাখতে সম্মিলিত কণ্ঠস্বরে গাইত ‘বেলা চাও…বেলা চাও…’ গানটি। ক্লান্তিভাবকে দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া সেই প্রেরণাদায়ক গান পরবর্তী সময় শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ধ্বনিত হতে লাগল প্রতিবাদীদের কণ্ঠে। আবার এই গানই ভোল পাল্টে ইতালীয় সামাজিক প্রজাতন্ত্র, জার্মান নাৎসিদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামে ব্যবহৃত হতে হতে একসময় হয়ে উঠল ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ও প্রতিরোধের সংগীত। অথচ এখন বাণিজ্যিকীকরণের দরুণ  ইলেকট্রনিক মিউজিকের সম্মিলনে সেই ‘বেলা চাও’ গানটি এখন সানন্দে আধুনিক প্রজন্মের মুখে মুখে ফিরছে।  ইতালির অস্তিত্বের স্মারক গানটির মূল প্রসঙ্গ হারিয়েও বিশ্বায়নের যুগে গৃহীত হয়েছে মানুষের কাছে। তবে ‘বেলা চাও’ই কিন্তু একমাত্র উদাহরণ নয়। পণ্যায়নের উদ্দেশ্যে বহুমাত্রিক ব্যবহারে বৃহত্তর শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে গিয়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অজস্র গান পুনঃ আবিষ্কৃত হয়েছে, রদবদল ঘটেছে। সেই লক্ষ্যেই ২০০৭ সালে ব্রাজিলে কোক স্টুডিওর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। তারই সম্প্রসারণের ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কোক স্টুডিও বাংলা। বিগত দুই মৌসুমে দর্শক-শ্রোতাদের উপহার দিয়েছে ১৭টি গান।

কোক স্টুডিও বাংলা এখন এক উন্মাদনার নাম। এই প্লাটফর্মের গান বিভিন্নজনেরা যেমন পছন্দ করছেন, তেমনি কোনো কোনো গান নিয়ে প্রতিক্রিয়াও কম হয়নি। কোক স্টুডিও বাংলার গান নিয়ে দর্শকের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কারণ কী?

কোলাজ: আমিনুল ইসলাম

কোলাজ: আমিনুল ইসলাম

হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মধ্যে ইতালীয় কৃষক-শ্রমিকেরা নিজেদের উদ্দীপিত রাখতে সম্মিলিত কণ্ঠস্বরে গাইত ‘বেলা চাও…বেলা চাও…’ গানটি। ক্লান্তিভাবকে দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া সেই প্রেরণাদায়ক গান পরবর্তী সময় শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ধ্বনিত হতে লাগল প্রতিবাদীদের কণ্ঠে। আবার এই গানই ভোল পাল্টে ইতালীয় সামাজিক প্রজাতন্ত্র, জার্মান নাৎসিদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামে ব্যবহৃত হতে হতে একসময় হয়ে উঠল ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ও প্রতিরোধের সংগীত। অথচ এখন বাণিজ্যিকীকরণের দরুণ  ইলেকট্রনিক মিউজিকের সম্মিলনে সেই ‘বেলা চাও’ গানটি এখন সানন্দে আধুনিক প্রজন্মের মুখে মুখে ফিরছে।  ইতালির অস্তিত্বের স্মারক গানটির মূল প্রসঙ্গ হারিয়েও বিশ্বায়নের যুগে গৃহীত হয়েছে মানুষের কাছে। তবে ‘বেলা চাও’ই কিন্তু একমাত্র উদাহরণ নয়। পণ্যায়নের উদ্দেশ্যে বহুমাত্রিক ব্যবহারে বৃহত্তর শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে গিয়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অজস্র গান পুনঃ আবিষ্কৃত হয়েছে, রদবদল ঘটেছে। সেই লক্ষ্যেই ২০০৭ সালে ব্রাজিলে কোক স্টুডিওর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। তারই সম্প্রসারণের ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কোক স্টুডিও বাংলা। বিগত দুই মৌসুমে দর্শক-শ্রোতাদের উপহার দিয়েছে ১৭টি গান।

 ‘দেওরা’ গানে ইসলাম উদ্দিন পালাকার ও প্রীতম হাসান

‘দেওরা’ গানে ইসলাম উদ্দিন পালাকার ও প্রীতম হাসানছবি: সংগৃহীত

সংগীত শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, রুদ্ধশ্বাস পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ডামাডোল থেকে পরিত্রাণস্বরূপ এই সংগীতই ব্যক্তি হৃদয়ের অনুভূতির সঙ্গে নিবিড় সংযোগ করে নেয়। সুর-শব্দের মূর্ছনায় কোনো দূরাগত স্মৃতি, ফেলে আসা মোহ, অনুভূতিকে টেনে এনে ব্যক্তিনির্বিশেষে প্রতিটি গানই হয়ে ওঠে একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রতিরূপ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর ঘোড়দৌড়প্রবণ ‘জেন জেড’ প্রজন্মের ব্যস্ত জীবনে গান শুধু সুর-শব্দ দিয়ে হৃদয়ে পৌঁছাতে পারছে না। যথোপযুক্ত আবহ, প্রাচ্যের বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্রের সিনক্রোনাইজেশন বা সমলয় বিধানের সঙ্গে সঙ্গে গানকে এখন সব প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে ভিজ্যুয়াল অভিজ্ঞতাও দিতে হয়। কোক স্টুডিও বাংলা তার পরিবেশনায় এসব বিষয়কে যেমন মাথায় রাখছে, একইভাবে মূল সুর অনুসরণে নজরুল সংগীত, বাউল গান, সারি গান, ভাটিয়ালি গান, হাজং গান ইত্যাদিকে যুগোপযোগী করতে দিচ্ছে ‘কালের ছোঁয়া’। কোক স্টুডিও বাংলার যাবতীয় পরিবেশনার মধ্যেই এই মেশানো তথা ব্লেন্ডিং ব্যাপারটা মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, মিউজিকের ক্ষেত্রে যাকে আমরা অভিহিত করছি ‘ফিউশন’ নামে।

কোক স্টুডিও এই ব্লেন্ডিং কেবল পাশ্চাত্য ও দেশীয় মিউজিকের মধ্যেই করে না, কেবল নানান গানের ব্লেন্ডিং-ই করে না, মানুষের চাহিদা-রুচি এসবেরও ব্লেন্ডিং তারা করে। ফলে তাদের এই পরীক্ষামূলক ব্লেন্ডিংয়ের ঘেরাটোপে পড়ে গান কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে হৃদয়ের সংযোগ না হয়ে গোলযোগের কারণও হচ্ছে।  

 ‘নাসেক নাসেক’ গানে অনিমেষ ও পান্থ কানাই

‘নাসেক নাসেক’ গানে অনিমেষ ও পান্থ কানাইছবি: সংগৃহীত

কোক স্টুডিও বাংলার টার্গেট অডিয়েন্স কারা?

প্রকৃতপক্ষে কোক স্টুডিও বাংলার টার্গেট অডিয়েন্স হলো প্রধাণত শহুরে উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা শিকড়ের কাছে যেতে আগ্রহী, বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, লোকশিল্পের স্বাদ নিতে উৎসুক।

কিন্তু এই টার্গেট অডিয়েন্সের মধ্যেও সব বয়সের মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে প্রয়োজন একটা শক্তিশালী ‘লোকাল কালচার’ বা স্থানিক সংস্কৃতির উদ্ভাবন করা, যা হবে প্রাচ্যের আর পাশ্চাত্যের সমন্বয়ে গড়া। কোক স্টুডিও বাংলা সেই সংগীত আয়োজনের জন্য পরীক্ষামূলক কম্পোজিশন, গ্রামীণ স্থানীয় শিল্পীর সঙ্গে শহুরে শিল্পীদের সম্মিলন আর বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে পৌঁছাতে চাচ্ছে তাদের অভীষ্ট দর্শক-শ্রোতাদের কাছে। উদহারণস্বরূপ বলা যায়, কোক স্টুডিও বাংলার সূচনাতেই অনিমেষের উৎসবমুখর প্রগলভতার ‘নাসেক নাসেক’-এর সঙ্গে পান্থ কানাইয়ের কণ্ঠে চর্চিত ‘দোল দোল দুলুনি’ গানে গাঁয়ের বধূর মান ভাঙানোর আখ্যান—দুইয়ে মিলে এক অদ্ভুত সুন্দর সুরঝংকার তৈরি হয়। এই নির্দিষ্ট অঞ্চলের, নৃ-গোষ্ঠীর, শ্রেণির মানুষদের যাপিত জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গানগুলোকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত গ্রাহকের শ্রবণোপযোগী করে তোলার অভিপ্রায়ে পরবর্তী সময় ‘মুড়ির টিন’, ‘দেওরা’র মতো গান এসেছে।

গান এখন আর কেবল শোনার গণ্ডিতে আবদ্ধ নেই। গেল দুই–তিন দশক জুড়ে বিশ্ব সংগীতের আঙিনায় গান ও নাচের যে মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে, তা একে অন্যতর এক পরিবেশনার স্তরে উন্নীত করেছে।

 ২৫ এপ্রিল স্বাধীনতা দিবসে ফ্যাসিবাদবিরোধী গান 'বেলা চাও' গাচ্ছেন ইতালীয়রা

২৫ এপ্রিল স্বাধীনতা দিবসে ফ্যাসিবাদবিরোধী গান ‘বেলা চাও’ গাচ্ছেন ইতালীয়রাছবি: সংগৃহীত

মিউজিক ভিডিওতে  এই গান আর নাচের সমন্বয়ের প্রভাব পরবর্তী সময় আরও বেড়েছে টিকটক, ইনস্টাগ্রামসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এসব প্ল্যাটফর্মে গানের এক নতুন আঙ্গিক আবির্ভূত হয়, যেখানে গানের নির্দিষ্ট অংশ মূল গান বাদেও দৈনন্দিন অন্য কোনো ঘটনার মূলভাবের সঙ্গে মিলে যায় এবং গানের অংশ ব্যবহৃত ওই ঘটনার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে। এতে প্রত্যক্ষভাবে মূল গানের সংযোগ দেখা না গেলেও পরোক্ষভাবে ওই গানের প্রচারণা হচ্ছে। এই প্রভাব চোখে পড়ে প্রথম কোক স্টুডিওর ‘নাসেক নাসেক’ গানে। তরুণ সমাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গানটি বিভিন্ন রিলস, ডান্স পারফরম্যান্সের মাধ্যমেই। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘নদীর কূল নাই’ গানটি বিষাদময় হাহাকারের মধ্য দিয়ে যে গল্প বলে, তার সঙ্গেও নিজেদের জীবনের নানা সাদৃশ খুঁজে নিচ্ছে নগরবন্দী মানুষ। ‘বনবিবি’, ‘মুড়ির টিন’, ‘নদীর কূল’ গানগুলোর মিউজিক ভিডিওর দৃশ্যায়নে কোক স্টুডিওর শৈল্পিক প্রয়াস চোখে পড়ার মতো। ‘মুড়ির টিন’ গানের সঙ্গে মিল রেখে স্টুডিওতে বেশ কয়েকটি সত্যিকারের মুড়ির টিন এনে রাখা হয়। লোকাল বাসে যাত্রী ওঠানোর সময় বাসের গায়ে চাপড় দিলে যে রকম শব্দ হয়, তার মূল ভাব ফুটিয়ে তোলার জন্য টিনের ট্রাংক ব্যবহার করা হয়েছে। বাস থামার লাল-সবুজ-হলুদ সংকেত কিংবা ‘হর্ন নিষেধ’—সব ধরনের সাইনবোর্ড ছিল গানের দৃশ্যায়নে। এই সবকিছু  মিলিয়ে কোক স্টুডিও বাংলার দর্শক-শ্রোতাদের এক ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’–এর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।

এই পরীক্ষামূলক ফিউশন নব্বই বা শূন্য দশকের প্রজন্মের কাছে উপভোগ্য হলেও এত দিন ধরে একটা নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে, গায়কিতে, পরিবেশনায় শুনে আসা গানকে হঠাৎ বদলে যেতে দেখে পছন্দ করছেন না অনেকেই। তা ছাড়া একেকটা গান একটা জাতির আর্থসামাজিক পরিচয়, ইতিহাসেরও অংশ বটে। তাই শুধু বাণিজ্যিকীকরণের জন্য এমন বদলে যাওয়াটাকে সমর্থন করেন না কেউ কেউ। এ কারণে তারা মনে করছেন, সাংস্কৃতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপট ছাড়াই  শহুরে গ্রাহকের উপযোগী করে তুলতে এসব গানে খানিকটা জোর করেই জুড়ে দেওয়া হয়েছে পপ সংগীতের অনুষঙ্গ। এতে তাদের কাছে গানটির গ্রহণযোগ্যতা কমছে, অথচ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সমালোচনা।

এই পরীক্ষামূলক ফিউশন নব্বই বা শূন্য দশকের প্রজন্মের কাছে উপভোগ্য হলেও এত দিন ধরে একটা নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে, গায়কিতে, পরিবেশনায় শুনে আসা গানকে হঠাৎ বদলে যেতে দেখে পছন্দ করছেন না অনেকেই। তা ছাড়া একেকটা গান একটা জাতির আর্থসামাজিক পরিচয়, ইতিহাসেরও অংশ বটে। তাই শুধু বাণিজ্যিকীকরণের জন্য এমন বদলে যাওয়াটাকে সমর্থন করেন না কেউ কেউ। এ কারণে তারা মনে করছেন, সাংস্কৃতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপট ছাড়াই  শহুরে গ্রাহকের উপযোগী করে তুলতে এসব গানে খানিকটা জোর করেই জুড়ে দেওয়া হয়েছে পপ সংগীতের অনুষঙ্গ। এতে তাদের কাছে গানটির গ্রহণযোগ্যতা কমছে, অথচ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সমালোচনা।

যখন পৃথিবীর সামগ্রিক পরিবেশ-পরিস্থিতির বদলে খোদ লোকগান ও লোকশিল্পীরা পর্যুদস্ত, নতুন প্রজন্মের মানুষ শিকড় থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন, ঐতিহ্য সম্পর্কে উদাসীন, তখন কোক স্টুডিও বাংলার সায়ান চৌধুরী অর্ণব ও অন্য সহশিল্পীদের এই মিউজিক্যাল ফিউশনের মধ্য দিয়ে যুগোপযোগী, উপভোগ্য করে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াসকে পুরোপুরিভাবে নাকচ করে দেওয়াটা সমীচীন নয়। হয়তো সময়ের সঙ্গে নিজেদের সংস্কৃতিকে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার জন্য এই ফিউশনগুলোই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।

Add comment

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.