রাষ্ট্র, ধর্মবাদী থেকে প্রগতিশীল—সবাই একযোগে সাদত হাসান মান্টোকে খারিজ করে দিলেও তিনি গল্পকার হিসেবে নিজের অবস্থান জানতেন। মৃত্যুর এক বছর আগে লেখা নিজের এপিটাফে তিনি বলে গেছেন, ‘এখানে সমাধি তলে শুয়ে আছে মান্টো আর তাঁর বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প বলার সব কৌশল আর রহস্য।’ কখনো ফতোয়া এসেছে, অশ্লীলতার জন্য মামলা হয়েছে ছয়বার, বন্ধুরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু মান্টোর চারপাশে বয়ে চলা জীবনের প্রতি আকর্ষণ আর তাঁর কলম কেউ থামাতে পারেনি।
বেঁচেছেন মাত্র ৪৩ বছর। কিন্তু লিখে গেছেন কী প্রবল উদ্যমে! ২২টি ছোটগল্পের সংকলন, একটা উপন্যাস, রেডিও নাটকের সাতটা সংগ্রহ, তিনটা প্রবন্ধসংকলন আর দুইটা চেনা মানুষদের স্মৃতিকথা! তাঁর লেখা সিনেমার চিত্রনাট্যগুলো এক করে ছাপানো হয়েছে বলে জানা যায় না। এগুলোর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ লিখেছেন দুই দানবের জন্য—পানীয় আর সংসার।
তবে এই পানীয় আর সংসার চালাতে যেসব গল্প লিখছেন মান্টো, তাতে যেন তিনি ১৯৪৭-এর দাঙ্গার চলমান ছবি তুলে রাখছেন! এমন নিস্পৃহ কিন্তু নির্মম কাজ কেন করলেন মান্টো?
বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়েন মান্টো। পত্রিকা অফিসে গিয়ে নাছোড়বান্দার মতো টাকা চান, পরে লিখে শোধ করে দেবেন। এমন হিসাবে তো পত্রিকা চলে না। সম্পাদক কাগজ-কলম এগিয়ে দিয়ে বলেন—মান্টো সাহেব, কিছু একটা লিখে দিন। মদ আর বাজার খরচের টাকার জন্য দুশ্চিন্তিত লেখক সদ্য দেখা দাঙ্গার গল্প লিখে দেন কাঁপা কাঁপা হাতে।
![সাদত হাসান মান্টো প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরোনো ‘কালো সীমানা’র প্রচ্ছদ](https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2023-05%2F8ff31eec-b458-4c9d-ab53-26b5cff2b591%2FKalo_Simana.jpg?auto=format%2Ccompress&fmt=webp&format=webp&w=300&dpr=0.9)
সাদত হাসান মান্টো প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরোনো ‘কালো সীমানা’র প্রচ্ছদ
মানুষের মন আর কদর্যতার বহুমাত্রা তুলে আনতে তাঁর কোনো জুড়ি নেই! তিনি দেখেছেন যে বর্তমান যখন অতীত হয়, তখন সবকিছু কেমন প্রয়োজনমতো বদলে দেওয়া হয়। তাই কি তিনি কেবল যা ঘটেছে তার অবিকল ফটোগ্রাফ মাত্র রেখে গেছেন তাতে কোনো পক্ষের, ঘৃণার বা সহমর্মিতার কোনো রং না লাগিয়ে?
দেশভাগের মতো এক ঘোর মানবিক বিপর্যয়ের পর একটা বই লেখেন মান্টো। বইটির নাম ‘সিয়াহ হাশিয়ে’ বা ‘কালো সীমানা’। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, এই বই তিনি লিখেছিলেন স্রেফ মদের খরচ আর সংসার খরচের জন্য।
কিন্তু যখন মান্টো বইটি লিখছিলেন, তখন তিনি নিজেই-বা কোথায়, কেমন আছেন?
তিনি তখন বম্বে ছেড়ে লাহোর পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর ভালোবাসার বম্বের সিনেমাজগৎ, তাঁর বন্ধু আর চেনা মুখগুলো সহসা অচেনা হয়ে যাওয়ার শহর ছেড়ে তিনি যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছেন। লাহোরের সিনেমাজগৎ তখন সবে বুঝতে শুরু করেছে যে তার সামনে বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু তা বাস্তব হয়ে উঠতে অনেক দেরি।
মান্টো তত দিনে প্রগতিশীল ঘরানা থেকে ধর্মবাদী আর রাষ্ট্র—সবার সমান চক্ষুশূল। সংসার চালানোর টাকা জোগাড় করা কঠিন হচ্ছে দিন দিন। প্রিয় বন্ধু ইসমত চুগতাইয়ের কাছে তিনটি চিঠিতে মান্টো বলছেন—কোনোভাবে আমাকে ফেরত নিয়ে যাও, এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
মদের প্রতি মান্টোর আকর্ষণ ছিল আগেও। এই ‘পরবাসে’ এসে বন্ধু আর সহায়হীন হয়ে তা হয়ে গেল নেশা। বুদ্ধিমান লেখকেরা তখন সরকারের কাছ থেকে বাড়ি, ব্যবসা ইত্যাদি বরাদ্দ নিয়ে নিচ্ছে। এতটা বাস্তববুদ্ধি মান্টোর কোনোকালেই ছিল না। একমাত্র অবলম্বন পত্রিকায় লিখে রোজগার। তাও কি সহজ? কোনো কিছুই তখনো বোঝা যাচ্ছে না। ইংরেজ সরকারের আমলের অশ্লীলতার অভিযোগে করা মামলা নতুন দেশের সরকার উঠিয়ে নেয়নি। আমৃত্যু সেই বোঝা তাঁকে বইতে হয়েছে। তাঁর লেখা ছাপতে পত্রিকার সম্পাদক ভয় পান, কখন পত্রিকা বন্ধের খাঁড়া নেমে আসে কে জানে?
বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়েন মান্টো। পত্রিকা অফিসে গিয়ে নাছোড়বান্দার মতো টাকা চান, পরে লিখে শোধ করে দেবেন। এমন হিসাবে তো পত্রিকা চলে না। সম্পাদক কাগজ-কলম এগিয়ে দিয়ে বলেন—মান্টো সাহেব, কিছু একটা লিখে দিন। মদ আর বাজার খরচের টাকার জন্য দুশ্চিন্তিত লেখক সদ্য দেখা দাঙ্গার গল্প লিখে দেন কাঁপা কাঁপা হাতে। সেই গল্প কখনো কেবল এক লাইন, বেশি হলে পৃষ্ঠা দেড়েক।
এভাবে লেখা ৩২টা গল্প নিয়ে ১৯৪৮ সালে বের হয় ‘সিয়াহ হাশিয়ে’—আগেই বলেছি, এই নামের মানে হলো ‘কালো সীমানা’। নামটি দ্ব্যর্থবোধক। এক অর্থে কালো সীমান্ত, নতুন দেশের বর্ডার, মান্টো যাকে কালোই বলতেন। আরেক অর্থ হলো, পত্রিকায় কোনো শোকসংবাদ বা দুঃখের সংবাদ যে কালো বর্ডারে ছাপা হয়, সেই কালো সীমানা।
এই বই মান্টো আর প্রগতিশীল লেখক সংঘের মধ্যে বিচ্ছেদেরও কারণ হলো। মান্টো এই বইয়ের ভূমিকা লিখতে দিলেন হাসান আসকারিকে। আসকারি নতুন পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে দায়িত্ব পেয়েছিলেন নতুন রাষ্ট্রের পরিচয় কী হবে, সে ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার। তিনি ছিলেন লেখক সংঘের সাহিত্য দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী।
লেখক সংঘের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সরদার জাফরি, আহমদ নাদিম কাসমি মান্টোকে অনুরোধ করলেন আসকারিকে দিয়ে ভূমিকা না লেখাতে। মান্টো চুপ রইলেন। আসকারির ভূমিকাসহই বই বের হলো। প্রগতিশীল লেখক সংঘের সঙ্গে মান্টোর বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হয়ে গেল। মান্টো বন্ধুহীন হয়ে পড়লেন। বন্ধু বলতে রইল তাঁরা, যারা তাঁকে সস্তা মদ জোগাড় করে দেয়, যারা তাঁর মৃত্যু এগিয়ে নিয়ে এসেছিল।
‘সিয়াহ হাশিয়ে’ বা ‘কালো সীমানা’ গল্পগ্রন্থ থেকে দুটি গল্প
কেরামতি
লুট করা মাল উদ্ধার করার জন্য পুলিশ তল্লাশি শুরু করল।
লোকজন ভয় পেয়ে লুট করা মাল বাইরে ফেলে আসতে লাগল। কেউ কেউ তো পুলিশের হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের মালপত্রও বাইরে ফেলে দিল।
এর মধ্যে একজন খুব ঝামেলায় পড়ে গেল।
তার কাছে মুদিদোকান থেকে লুট করে আনা দুই বস্তা চিনি ছিল। এক বস্তা সে রাতের অন্ধকারে কোনোরকমে পাশের কুয়ায় ফেলে দিল কিন্তু দ্বিতীয় বস্তা ফেলতে গিয়ে নিজেও বস্তার সঙ্গে কুয়ায় পড়ল।
শব্দ শুনে লোকজন ঘুম থেকে উঠে এল। কুয়ায় দড়ি ফেলা হলো। দুজন জওয়ান ছেলে কুয়ায় নামল। লোকটাকে তুলে আনা হলো। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর মরে গেল সে।
এর পরদিন যখন লোকজন কুয়া থেকে জল তুলল, দেখল কুয়ার পানি মিষ্টি!
সেই রাতেই ওই লোকের কবরে প্রদীপ জ্বলা শুরু হলো।
সংশোধন
‘কে তুই?’
‘তুই কে?’
‘হর হর মহাদেব…হর হর মহাদেব।’
‘হর হর মহাদেব।’
‘প্রমাণ কী?’
‘প্রমাণ…আমার নাম ধরম চাঁদ।’
‘এটা কোনো প্রমাণ নয়।’
‘চার বেদ থেকে আমাকে যা ইচ্ছা জিজ্ঞেস করো।’
‘আমরা বেদ-টেদ জানি না, প্রমাণ দাও।’
‘কী?’
‘পাজামা নামাও।’
পাজামা নামানোর পর কোলাহল শুরু হয়ে গেল। ‘মার, মার, মেরে ফেল।’
‘থামো থামো…আমি তোমাদের ভাই…ভগবানের কসম, আমি তোমাদের ভাই।’
‘তাহলে এটা কী?’
‘যে এলাকা পার হয়ে এসেছি, ওটা আমাদের দুশমনের এলাকা। বাধ্য হয়ে আমাকে এটা করতে হয়েছে, শুধু জান বাঁচানোর জন্য, এই একটাই ভুল হয়ে গেছে। বাকি সব তো ঠিক আছে।’
‘খতম কর, সব ভুল-টুল।’
ভুল সংশোধন করা হলো। সেই সঙ্গে ধরম চাঁদও খতম হয়ে গেল।
Add comment