Nazihar News Network

যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে দিতে যা দেখলাম

গ্রীষ্মের ছুটি। প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে ভালোই। আমি, আমার স্বামী, কৈশোর ছুঁই ছুঁই ছেলে রাইফ আর বিশ্বস্ত পথসঙ্গী আমাদের গাড়ি। গাড়িভর্তি তিন সপ্তাহের খাবার, পানীয়, জামাকাপড়, জরুরি ওষুধপত্র, ক্যামেরা, বাইনোকুলার। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব থেকে পশ্চিমের জনবিরল জায়গাগুলো পেরিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে ১০ হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। ‘যেখানে রাত সেখানেই কাত’—এমনটিই পরিকল্পনা। রাইফের উত্তেজনা আরও প্রবল। সে সঙ্গে নিয়েছে একগুচ্ছ গল্পের বই। দেখা যাক কেমন হয় আমাদের অভিযাত্রা।

গ্রীষ্মের ছুটি। প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে ভালোই। আমি, আমার স্বামী, কৈশোর ছুঁই ছুঁই ছেলে রাইফ আর বিশ্বস্ত পথসঙ্গী আমাদের গাড়ি। গাড়িভর্তি তিন সপ্তাহের খাবার, পানীয়, জামাকাপড়, জরুরি ওষুধপত্র, ক্যামেরা, বাইনোকুলার। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব থেকে পশ্চিমের জনবিরল জায়গাগুলো পেরিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে ১০ হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। ‘যেখানে রাত সেখানেই কাত’—এমনটিই পরিকল্পনা। রাইফের উত্তেজনা আরও প্রবল। সে সঙ্গে নিয়েছে একগুচ্ছ গল্পের বই। দেখা যাক কেমন হয় আমাদের অভিযাত্রা।

ওয়াইওমিংয়ের টিটন পর্বতের পাদদেশে লেখক
ওয়াইওমিংয়ের টিটন পর্বতের পাদদেশে লেখক

মেঘের দেশে

টানা তিন দিনের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আমরা তখন ওয়াইওমিংয়ের পথে। জানালা দিয়ে প্রকৃতির চেহারা ক্রমাগত বদলে যেতে থাকল। আমাদের গাড়ি দুই পাশে সারি সারি গাছের ঘন বনকে পেছনে ফেলে সামনে তুষারঢাকা পাহাড়ের পথে এগিয়ে যায়। তারপর শুরু হয় চড়াই-উতরাই পাহাড়ি রাস্তা। জানালা দিয়ে পাহাড়ের কোলে দেখতে থাকলাম ঘোর লাগানো মেঘের খেলা।

পেছনে মন্টানার বরফের নদী
পেছনে মন্টানার বরফের নদী

হিমবাহ অভিযান

আরেক দিনের অভিযান। হিমবাহ দেখব। রওনা হয়ে গেলাম মন্টানার উদ্দেশে। রৌদ্রোজ্জ্বল ঝকঝকে হেলেনা শহরের ওপর দিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। মেঘমুক্ত আকাশ। দুই পাশে খোলা আর বিস্তীর্ণ দিগন্ত। অনেক দূরে সেই ধূসর হিমবাহ পাহাড়ের সারি। চারপাশে কোথাও জনমানবের কোনো অস্তিত্ব নেই। এই নির্জনতায় গাড়িতে চড়া স্বরে বেজে চলেছে কোলাহলের গান। আর এভাবেই পেছনে ফেলে এলাম কয়েক শ মাইল। একে একে বেশ কয়েকটা উপশহর পার হয়ে অবশেষে পৌঁছালাম সেই কাঙ্ক্ষিত বরফ নদীর দেশে। বরফগলা নদী নয়, বরফের নদী। হিমবাহের হিম বাতাসে সে এক ‌অদ্ভুত অনুভূতি।

যত দূর চোখ যায়, ধবধবে লবণের জমাট সাদা প্রান্তর
যত দূর চোখ যায়, ধবধবে লবণের জমাট সাদা প্রান্তর

লবণের মতো ভালোবাসা

সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার বিকেল। নিজেকে বারবার চিমটি কেটে বুঝলাম, এ তো স্বপ্ন নয়, যা দেখছি সত্য। জেগেই বিস্ময় দেখছি। এমন এক দৃশ্য যে চোখে ধাঁধা লেগে গেল। ঘুরতে ঘুরতে ইউটাহ রাজ্যের একেবারে শেষ সীমানায় এমন এক জায়গায় আমরা এসে পড়লাম, যেখানে মাটিতে মিশে গেছে আকাশ। যত দূর চোখ যায়, ধবধবে লবণের জমাট সাদা প্রান্তর। যেন হাঁটছি কোনো স্বর্গীয় জগতে। স্বচ্ছ মেঘের আকাশ আর শুভ্র লবণের ভূমি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। এ কি আমাদের চিরচেনা পৃথিবী, নাকি অন্য কোনো ভুবন! সে এক আশ্চর্য গোলকধাঁধা!

পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম স্থান পূর্ব ক্যালিফোর্নিয়ার ‘ডেথ ভ্যালি’ এটা
পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম স্থান পূর্ব ক্যালিফোর্নিয়ার ‘ডেথ ভ্যালি’ এটা

ভয়ংকর সুন্দর

এ এক কুখ্যাত জায়গা। মনোরম কোনো দৃশ্য এখানে নেই। ভালো লাগার মতো কিছুই নেই। সবই ধূসর আর শুষ্ক। সবকিছুই মৃত। পাহাড়, মাটি, বন—সব মৃত। মৃত্যু উপত্যকা এটা। মাথার ওপরে গনগনে সূর্য আর তার প্রখর রোদ। বসবাসের বিরূপ পরিবেশ। শোনা কথা, এখানে একটানা চার ঘণ্টার বেশি মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। প্রাণশূন্য সে পথে মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ে অতিরিক্ত গরমের সতর্কবার্তা। প্রচণ্ড পিপাসায় অস্থির লাগবে, পানি খুঁজে পেতে হলে জাদুকর হতে হবে। মৃত্যুই সেখানে একমাত্র শীতলতা। হ্যাঁ, পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম স্থান পূর্ব ক্যালিফোর্নিয়ার ‘ডেথ ভ্যালি’তে এভাবেই এক ছায়াবিহীন, রুক্ষ পথে জীবনের উষ্ণতম দুপুরটা কাটালাম আমরা। সেদিন ফারেনহাইটে ১১৬ আর সেন্টিগ্রেডে ৪৭ ডিগ্রি ছুঁয়েছিল তাপমাত্রার কাঁটা। তবে আমরা যারা গরমের দেশের মানুষ, তাদের জন্য এ তো কোন ছার! সত্যি বলতে কি, ডেথ ভ্যালিতে সেদিন আমাদেরও খুব গরম লেগেছিল, গাড়িতে তেল নিতে গিয়ে তার তিন গুণ দাম দেখে!

গাড়ি ভর্তি নানা রকম খাবার ও দরকারি জিনিসপত্র
গাড়ি ভর্তি নানা রকম খাবার ও দরকারি জিনিসপত্র

আগুনের উপত্যকা

সে আবার কী? ঠাট্টার মতো শোনালেও নেভাদা অঞ্চলের এই লাল পাহাড়গুলো যেন আগুনের একেকটি লেলিহান শিখা। রূপে তার সত্যিই আগুন জ্বলে! মাঝখানে ঢেউ খেলানো পিচ রাস্তা। প্রশান্তির ধারা হয়ে নীরবে বয়ে গেছে। আমাদের গাড়ি চলছিল ইউটাহ আর অ্যারিজোনার বর্ডার বরাবর। রাস্তার দুই পাশে আকাশচুম্বী বিমূর্ত লাল পাহাড়গুলো যেন দুর্গের ওপর দুর্গ। এখানেই থেমেছিল ‘ফরেস্ট গাম্প’রূপী টম হ্যাংকসের অবিরাম পথচলা। সেদিন পাহাড়ের গায়ে ছিল পড়ন্ত বিকেলের সোনা সোনা রোদের আলো আর বাতাসে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির গন্ধ। চঞ্চল মনে ঝিরিঝিরি শুনতে পাচ্ছিলাম ‘রেইনড্রপস কিপ ফলিং অন মাই হেড’।

আলোকের এই ঝর্ণাধারা
আলোকের এই ঝর্ণাধারা

আশ্চর্য আলোর ঝরনা

ছবি দেখে কেউ ভাবতে পারে, কম্পিউটারের কোনো ওয়ালপেপার কিংবা মঞ্চনাটকের কোনো সেট। লাখ লাখ বছর আগে প্রচণ্ড জলপ্রবাহ দ্বারা সৃষ্ট এক বিস্ময় অ্যান্টেলোপ ক্যানিয়ন। সেদিন নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে ট্যুর গাইডের জন্য ‌অপেক্ষা করছিলাম। তিনি এলেন। উপস্থিত সবাইকে প্রথমে ভূমিকা ও কিছু নিয়ম বর্ণনা করলেন। তারপর বেশ উঁচু, খোলা একটি জিপগাড়িতে কয়েকজন ভ্রমণসঙ্গী নিয়ে যাত্রা শুরু করল আমাদের দল। ছাদখোলা সেই জিপ ছুটে চলল অ্যারিজোনার উত্তপ্ত মরুভূমির বুকে। শুনতে সহজ হলেও পথটা তেমন নয় মোটেও; যেমন ঝাঁকুনি, তেমনি ধুলা। আমাদের নিয়ে গেল লোকালয় থেকে বেশ গহিনে। একেবারে ক্যানিয়নের সেই প্রবেশমুখে এসে থামল গাড়ি। লাফ দিয়ে নেমে ভেতরে ঢুকতেই আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গপথের মতো মনে হলো। এ জায়গা কিন্তু গুহা নয়, তবু সুয্যিমামা এখানে উঁকি দেয় না। দিনের যে সময়ে সূর্য ঠিক মাথার ওপর থাকে, তখনই তার দেখা মেলে। পাথরের ফাঁক দিয়ে কেবল বিশেষ বিশেষ জায়গায় চুইয়ে পড়ে সূর্যরশ্মি। গ্রীষ্মের দুপুরে পাথরের রঙিন দেয়ালে সে এক আশ্চর্য আলোর ঝরনা। হঠাৎ মনে হলো, এ যেন মনের মণিকোঠা! হলুদ-কমলা-বাদামি পাথুরে দেয়াল আর আলো-ছায়ার মায়াজাল। লুকোচুরি খেলায় এখানে লুকিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া দায়!

কলারাডো নদীর বাঁকে
কলারাডো নদীর বাঁকে

জলপরি

এ এক আজব জায়গা! তা না হলে কেন এমন হলো? সবই তো ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ ঠিক এ জায়গাতে এসেই শান্ত কলোরাডো নদীটার আর সামনে এগোতে ইচ্ছা করল না। চট করে সাহসী ইউটার্ন নিয়ে আবার উল্টা দিকে ঘুরে গেল। কিন্তু রেখে গেল তার রূপের রেশ। গভীর খাদের বুকে অতল নীল জলরাশি। জায়গাটাই এমন। বড়ই আবেশময়। চুপচাপ একা একা বসে থাকার মতো। সেদিন অস্তগামী সূর্যের আলোয় ঝলমল করছিল প্রকৃতির অপার রূপ। চোখ ফেরানো দায়! কোনো এক নীরব সন্ধ্যায় জলপরিরা বুঝি চুপি চুপি এখানেই নেমে আসে। আনমনে মেতে ওঠে জলকেলি উৎসবে।

টেক্সাসের কোনো এক বিরান প্রান্তরে হাজারো হাওয়া-কলের মাঝে লেখিকা
টেক্সাসের কোনো এক বিরান প্রান্তরে হাজারো হাওয়া-কলের মাঝে লেখিকা

প্রজাপতি

মার্কিন ওয়াইল্ড ওয়েস্টে আবিষ্ট হয়ে থাকলাম পুরো তিন সপ্তাহ। ফিরছিলাম কলোরাডোর ডুরাঙ্গো থেকে নিউ মেক্সিকো হয়ে টেক্সাসের ‌‌আমারিলো নামের ছোট্ট শহরের ওপর দিয়ে। পাড়ি দিয়ে এসেছি হাজার হাজার মাইল। সে পথের ধারে রাজত্ব করে অন্য পশু, গাছে অন্য ফুল আর বাতাসে অন্য গন্ধ। চেনা সূর্যটাও প্রতিদিন উঠছে–ডুবছে ভিন্ন সময়ে। রোড ট্রিপ মানে তাই বারবার ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে সময় মিলিয়ে নেওয়া। ঠিকানাবিহীন পথের ধারে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে গরম চা বানিয়ে খাওয়া। দমকা বাতাসে উড়ে যাওয়া টুপির খোঁজে ছেলেমানুষি ভোঁ–দৌড়। রোড ট্রিপ মানে পাহাড়ের কোলে নদীর দুরন্ত ঢেউয়ের শব্দ। তুষারঢাকা পাহাড়ের নীরবতা। রোড ট্রিপ মানে মরুভূমির লু হাওয়া, চড়াই-উতরাই রাস্তা। রোড ট্রিপ মানে শুদ্ধতার সঙ্গে নিবিড় বন্ধুতা। রোড ট্রিপ মানে অ্যালার্মবিহীন ভোরবেলা। মিষ্টি রোদের একটা বিকেল। রোড ট্রিপ মানে অচেনা পথের বাঁকে হৃদয়ের স্পন্দন। অনেক দূরের একাকী পথে একসঙ্গে থাকার দাপট। রোড ট্রিপ মানে কখনো চলতে চলতে পথ হারিয়ে ফেলা। কখনোবা অবারিত প্রান্তরে প্রজাপতির ডানায় নিজেকে আরেকবার খুঁজে পাওয়া।

Add comment

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.